ছন্দ পতন

গর্ব (অক্টোবর ২০১১)

আহমেদ সাবের
  • ৬৯
  • 0
  • ২৮
জেলা স্কুলের মাঠের পাশে বট গাছের নীচে কালাম বসে আছে বন্ধুদের নিয়ে। আজ সকালে ছিল আন্তঃ স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতার জেলা ফাইনাল। কালামদের স্কুল অজ পাড়াগাঁর হলেও ফাইনালে জিতে ওরা জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কালামদের টিম নিয়ে প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক এবং বিজ্ঞান শিক্ষক আমজাদ আলী সাহেব গতকাল সকালে জেলা সদর এসেছেন। কাল থেকেই গ্রুপে গ্রুপে প্রতিযোগিতা চলছে। আমজাদ আলী সাহেব স্কুল জীবনে তুখোড় তার্কিক ছিলেন। তিনিই ঘষে মেজে কালামদের দলটা দাড় করিয়েছেন। রাতদিন খেটে কালাম, জহির আর বাদলকে বিতর্কের নিয়ম কানুন শিখিয়েছেন । পাকা জহুরীর মত কালামের মধ্যে একজন ভাল তার্কিক হবার সব লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ফলাফল প্রমাণ করেছে, তার নির্বাচনে ক্রুটি ছিল না। আজকের জেতাটা প্রধানতঃ কালামের একার গুনেই।

কালামের বাবা রমিজ উদ্দিন এসব ফালতু কাজে ছেলে সময় নষ্ট করুক, তা চান না। ছেলে যে সময় নষ্ট করে স্কুলে যাচ্ছে, এটাই তো বেশী। কোন মতে স্কুলের বেড়াটা ডিঙ্গাতে পারলেই হল। তারপর কালামকে পড়ানোর ইচ্ছা তার নাই। এখন ক্ষেতে ধানের চারা লাগানোর সময়। এ সময় ক্ষেতের কাজ ফেলে, লেখা পড়া ফেলে ছেলে কি সব তর্কাতর্কি নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছে, এটা তার ভীষণ অপছন্দ। কিন্তু, আমজাদ আলী সাহেব কালামের বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে কালামকে থানা প্রতিযোগিতা উৎরে, জেলা সদর পর্যন্ত টেনে এনেছেন।

কালাম এবং জহির দু জনেই দশম শ্রেণীর ছাত্র আর বাদল পড়ে নবম শ্রেণীতে। কালাম এবং জহির এক শ্রেণীতে পড়লেও ওদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। কালামের বাবা যেখানে গরীব বর্গা চাষি আর জহিরের বাবা এলাকার একজন নব্য ধনী। যদিও বিতর্কে জহির তেমন জুতসই নয় আর এতে ওর আগ্রহও নেই, তবু বাবার চাপে এবং উদ্যোগেই সে ওদের স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতার দলে স্থান পেয়েছে। এই প্রতিযোগিতার সুবাদেই কালাম জহিরের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছে। এবং দেখেছে, জহিরকে সে যতটা নাক উঁচু সে ভেবেছিল, আসলে সে তা নয়। ভীষণ দিল-দরিয়া স্বভাবের মানুষ সে। দেদার খরচ করে। কাপড় চোপড়ে দারুণ ফিটফাট। আচারে আচরণে বেশ কেতা দুরস্ত। আজও জহির এসেছে স্যুট কোট পরে। চোখে সান গ্লাস। অন্য দিকে কালামের গায়ে কুঁচকানো শার্ট, কালো চুলে তেল চক চক করছে।

সূর্য পশ্চিম এখন মাথার উপরে। আকাশে মেঘ করে আসছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফলাফল দেয়া হয়ে গেলেও, প্রতিযোগীদের বেশীর ভাগই এখনো স্কুল এলাকা ছেড়ে যায় নি, বিশেষ করে শীর্ষ চার দলের প্রতিযোগীরা। তার কারণ হচ্ছে, শীর্ষ চার দলের প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে তিন জনের একটা দল ঢাকায় সমগ্র বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পাঠানো হবে। তিন জনের মধ্যে কালাম যে থাকবে, সেই ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। আমজাদ আলী সাহেব এ ব্যাপারে একটু আগে কালামকে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। বাকী দু জন কারা হবে, সেই ব্যাপারে শিক্ষকদের আলোচনা চলছে। সবাই আশান্বিত যে, কালামের নেতৃত্বে ঢাকায় এবার ঢাকায় একটা শক্তিশালী দল পাঠানো সম্ভব হবে।

কালাম বন্ধুদের সাথে থাকলেও মন ওর এখানে নাই। বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য কয়েকদিন বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে পারেনি সে। বৃষ্টি নামবার আগে ধানের চারা গুলো লাগাতে না পারলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। সে মনে মনে প্রাণে প্রার্থনা করে, আগামী কালকের দিনটা পর্যন্ত যেন বৃষ্টি না হয়। তা হলে কাল সারাদিন খেটে ক্ষেতের কাজটা শেষ করে ফেলা যাবে। এক দিকে প্রতিযোগিতায় জেতার গর্বের ফানুস, অন্য দিকে সাংসারিক রূঢ় বাস্তবতা। দুয়ের টানাপড়েন ওকে বিধ্বস্ত করে তোলে। বন্ধুদের সাথে গল্পে মন লাগাতে পারে না সে। ক্ষেতে কর্মরত বাবার রুগ্ন শরীর ওর চোখের উপর ভেসে উঠে বার বার।

হঠাৎ একটা গাড়ীর শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে কালাম। কয়েকজন শিক্ষক গাড়ীর দিকে ছুটে যান। কালাম দেখে, জহিরের বাবা গাড়ী থেকে নামছেন। জহিরের উপর চোখ পড়ে কালামের। দেখে, ওর চোয়াল দুটো কঠিন হয়ে উঠেছে বরাবরের মত। জহিরের বাবা ওদের স্কুলে গেলেও ওর চোয়াল এমনি কঠিন হয়ে যায়। কালাম বলেছে, ওর সব ব্যাপারে নাক গলান বলে সে বাবাকে পছন্দ করে না। বিশেষ করে, ওর বাবার মতে পৃথিবীতে রানার্স আপের কোন স্থান নেই। তাই ওর বাবা চান, ওকে সব কিছুতে প্রথম হতে হবে। তার উপর জহিরের বাবা চান না, তার ছেলে চাষি, মজুরের ছেলেদের সাথে মিশুক। তার মতে, জীবনে উন্নতি করতে হলে আসমানের দিকে তাকাতে হবে, জমিনের দিকে নয়। বাবাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না সে। মনের কষ্ট নিয়ে নিজেই পুড়ে মরে।

সময় বয়ে যায়। মেঘের আড়ালে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। হঠাৎ একজন ছাত্র খবর নিয়ে আসে, ঢাকার বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য দল গঠন চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে। একটু পরেই নাম গুলো জানানো হবে। সবাই নিশ্চিত, কালাম তো থাকছেই। বাকী দু জন কে হবে, এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্য জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায়। এমন সময় একজন ছাত্র এসে কালামকে খবর দেয়, ওদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক সাহেব ওকে ডাকছেন। জহির কনগ্রেচুলেশন বলে কালামকে জড়িয়ে ধরে। অন্যান্য কয়েকজন ছাত্র কালামের সাথে হাত মেলায়। কালাম স্কুল ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গর্বে যেন ওর মাটিতে পা পড়ছে না। সবাই চেয়ে আছে ওর দিকে। স্কুলের বারান্দায় মোজাম্মেল হক সাহেব অপেক্ষা করছিলেন কালামের জন্য। ও আসতেই ওকে নিয়ে একটা খালি রুমের দিকে এগিয়ে যান তিনি। উত্তেজনায় চোখ মুখ গরম হয়ে গেছে কালামের। ভাগ্য ভাল, ঢাকার প্রতিযোগিতা হবে আগামী মাসে, যখন ক্ষেতের কাজ অনেক কমে আসবে।

বস। রুমে ঢুকেই একটা বেঞ্চ দেখিয়ে কালামকে বসতে বললেন মোজাম্মেল হক সাহেব।
কালাম বসলে তার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলেন তিনি।
দেখ, আন্তঃ স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জেলা চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য আমার পক্ষ থেকে তোমার দলকে অভিনন্দন।
ধন্যবাদ স্যার। বিনীত ভাবে বলে কালাম।
অনেক কষ্ট করেছ তোমরা তিন জন গত দু মাস থেকে। আজ তার ফল পেলে। তুমি তো জান, শীর্ষ চার দলের প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে তিন জনের একটা দল বাছাই করা হবে ঢাকা পাঠানোর জন্য।
জি স্যার। মাথা নত করেই উত্তর দেয় কালাম।

দুপুরের পর থেকে আমরা সবাই অনেক আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত তিন জনের নাম ঠিক করেছি। শুনে খুশী হবে, তিন জনের মধ্যে এক জন যাচ্ছে আমাদের স্কুল থেকে। কে কত ভাল বিতর্ক করলো, নির্বাচনের বেলা সেটা অবশ্যই কন্সিডার করা হয়েছে। বলে থামলেন মোজাম্মেল হক সাহেব। কালাম উত্তেজনায় ঘামতে থাকে। এই বুঝি স্যার ওর নাম বলবেন।

তবে, সেটাই একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। গলা পরিষ্কার করে আবার নিজের কথায় ফিরে যান মোজাম্মেল হক সাহেব। জীবনে যেন উন্নতি করতে হলে অল-রাউন্ডার হতে হয়, বিতর্কের ক্ষেত্রেও তাই। শুধু বাগ্মী হলে হবে না। পোষাকে আশাকে, আচার আচরণেও প্রেজেন্টেবল হতে হবে। সব কিছু বিচার বিবেচনা করে আমরা আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে জহিরকে নির্বাচিত করেছি। জানি, তুমি অনেক ভাল বিতর্ক করেছ .........।

মোজাম্মেল হক সাহেবের বাকী কথা গুলো কালামের কানে ঢুকে না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আহমেদ সাবের নাহিদ, এটা একটা রূঢ় বাস্তবের গল্প। আমরা সবাই কম-বেশী ভুক্তভোগী। গল্পটা পড়েছ বলেই আমি খুশী।
আহমেদ সাবের ধন্যবাদ খোরশেদুল আলম , আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। 'মাইকেল সাতা' র মত উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। যেমন - বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডক্টর আতিয়ার রহমান। তবে সেটা ব্যতিক্রম। আমরা যেন সকল কালাম দের প্রতিভার উৎকর্ষতার প্রতিবন্ধকতা গুলো দূর করতে পারি।
আহমেদ সাবের ধন্যবাদ প্রজাপতি মন , গল্পটা পড়বার জন্য।
খোরশেদুল আলম প্রকৃত জ্ঞানের মূল্যায়ন হয়না বলেই আমরা পিছিয়ে আছি- শেখসাদীর গল্প পোশাকের মূল্য, কয়েক দিন আগে- 'মাইকেল সাতা' সুইপার থেকে জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট র কথা মনে আসল। আমাদের দেশে অনেক ক্ষুদ্র বৈজ্ঞানিকের কথা পত্রিকায় পাই রাষ্ট্রীয় সুবিধা সহযোগীতার অভাবে তাদের জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয় না। ঠিক আমাদের সমাজেও অর্থ সম্পদ আর পোষাকের মূল্যই দেওয়া হয়। গর্বকে নিয়েই আমরা গর্ব করতে ভুলে গেছি। আমার মনে হয় কালামকে অভিনন্দন জানানোর আঘাত ই এই গল্পের প্রাণ। একজর গরীব কৃষকের ছেলের পোষাক ধনীদের মতো হতে পারে না। জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হলে জহিরের বাবার মতো এলাকার ধনীব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। জ্ঞানীদের মূল্যায়ন করার শিক্ষার জন্যই গল্পটি অসাধারণ।
খন্দকার নাহিদ হোসেন সাবের চাচা, কালামের হয়েছে বিতর্কের ক্ষেত্রে আর আমার এমন হয়েছে কবিতার ক্ষেত্রে। কতবার.........! আশার কথা ভালোবাসা থাকলে শেষমেশ সেই কষ্টগুলি বড় তুচ্ছ মনে হয়। গল্পের পরিণতিটা জানতাম তবুও শেষ পর্যন্ত না পড়ে উপায় ছিল না।
প্রজাপতি মন বাস্তব বড় রূঢ়! কালামের মত ছাত্ররা মার খেয়ে যায় ক্ষমতার কাছে। অনেক কষ্ট লাগছে কালামের জন্য।
আহমেদ সাবের গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ Monir Khalzee
আহমেদ সাবের গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ nilanjona nil
আহমেদ সাবের গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ চৌধুরী ফাহাদ।
মনির খলজি রূঢ. বাস্তবতা, 'পয়সায় বাঘের চোখও মিলে, আপদে মশাও ঢোকলা গিলে।' সবের ভাই, আপনার সুন্দর উপস্থাপনায় সামাজিক প্রেক্ষাপটে উপভোগ্য একটা গল্প .....আমাদের নিম্ন বিত্তের মানুষেরা কত যে অসহায় তা এখানে প্রমেয় ! ...শুভকামনা রইল ।

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪